আমাদের দেশের ৯০% মানুষই ভুল ভাবে দাঁত ব্রাশ করেন। এর জন্য দেখা যায় সঠিকভাবে দাঁতের যত্ন নেওয়া সত্ত্বেও অনেকের দাঁতে এবং মাড়িতে ইনফেকশন ধরা পড়ে। আর এর সবচেয়ে বড় কারণ হল দাঁত ব্রাশ করার ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম সম্পর্কে অনবগত থাকা ।
কিন্তু এটা কারো দোষ না। আমাদের স্কুল-কলেজে তো আর দাঁত ব্রাশ করার সঠিক নিয়ম শিখায় না। বরং অনেক ডেন্টিষ্টও তাদের প্রফেশনাল জীবনে প্রবেশ করার পূর্বে দাঁত ব্রাশ করার সঠিক নিয়ম ঠিকমতো জানতেন না ।
তাই দাঁত ব্রাশ করার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে আমাদের এই আর্টিকেলটি লেখা। সুতরাং আপনার এবং আপনার পরিবারে দাঁতের সুস্থতার নিশ্চিত করতে শেষ পর্যন্ত এই আর্টিকেলটি পড়ুন।
দাঁত ব্রাশ করার সঠিক নিয়ম (মডিফাইড বাস মেথদ)
মডিফাইড বাস মেথড (Modified Bass Method) হল দন্ত চিকিৎসার জগতে সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত একটি দাঁত ব্রাশ করার সঠিক নিয়ম । এই নিয়মটি ধাপে ধাপে নিম্নে উল্লেখ করা হলো –
ধাপ ১ঃ ব্রাশ দাঁতের সাথে ৪৫° কোণে ধরতে হবে
বেশিরভাগ মানুষ তাদের ব্রাশ দাঁতের সাথে সম্পূর্ণ সমান্তরাল ভাবে ধরে থাকেন । কিন্তু এভাবে দাঁত সঠিকভাবে পরিষ্কার হয় না । এর জন্য ব্রাশ ধরতে হবে আপনার দাঁতের সাথে সামান্য বাঁকিয়ে ৪৫° কোণে ।
অর্থাৎ ওপরের দাঁতের ক্ষেত্রে ব্রাশের মাথার সামান্য নিচের দিকে বাঁকাতে হবে। এবং নিচের দাঁতের ক্ষেত্রে মাথা সামান্য উপরের দিকে বাঁকাতে হবে। যাতে ব্রাশের চুলগুলো দুই দাঁতের মধ্যবর্তী যে সামান্য ফাঁকা জায়গা থাকে সেদিকে মুখ করে থাকে ।

ধাপ ২ঃ ব্রাশের মাথা হাল্কা চেপে ধরতে হবে
ব্রাশ সঠিকভাবে পজিশন করার পর এবার খুবই হালকা ভাবে চাপ দিতে হবে । যাতে ব্রাশের চুলগুলো সামান্য মাড়ির ভেতরে এবং পাশাপাশি দাঁতের মাঝখানের জায়গায় প্রবেশ করে।
লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে অতিরিক্ত চাপ দেওয়া না হয়। এতে দাঁত এবং মাড়ি ক্ষয় হয়ে যেতে পারে।
ধাপ ৩ঃ ব্রাশের সঠিক চালনা
প্রথমত, দাঁত এবং মাড়ির অন্তর্বর্তী যায়গায় ব্রাশ গোল গোল করে ঘোরাতে হবে। এরপর, আপনার দাঁতগুলোর মধ্যবর্তী স্থানগুলোতে সামান্য চাপ দিয়ে উপরের দাঁতের ক্ষেত্রে নিচের দিকে এবং নিচের দাঁতের ক্ষেত্রে উপরের দিকে ঘোরাতে হবে।
ধাপ ৪ঃ দাঁতের ভেতরের এবং উপরের পৃষ্ঠে গুরুত্ব দিতে হবে
অনেকেই দাঁতের ভেতরের পৃষ্ঠে যে ব্রাশ করতে হয় সেই ব্যাপারটি ভুলে যায়। তাই ঠিক একই নিয়মে দাঁতের ভেতরের পৃষ্ঠ ব্রাশ করতে হবে। দাঁতের উপরের পৃষ্টে যেখানে কামর লাগে সেখানে সামনে-পিছনে মোশন-এ দাঁত ব্রাশ করলেই যথেষ্ট।
দাঁত সঠিকভাবে পরিষ্কার করার কিছু টিপস
এখানে আমরা বাস মেথডের বাহিরেও দাঁত সঠিকভাবে পরিষ্কার করার কিছু বিশেষ টিপস নিয়ে আলোচনা করবঃ
দুই বেলা খাবার পর ব্রাশ করা
প্রতিদিন সকালে এবং রাতে ব্রাশ করতে হবে। এবং দুই বেলাই খাবার খাওয়ার পর দাঁত ব্রাশ করতে হবে।
ব্রাশ করার পর জিহ্বা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করুন
ব্রাশ করার পরও আপনার দাঁতের কিছু কিছু জায়গায় ময়লা থেকে যেতে পারে। তাই আপনার জিহবা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখবেন কোথাও আর একটু ব্রাশ করার প্রয়োজন আছে কিনা।
জিহ্বা পরিষ্কার করুন
দাঁতের পাশাপাশি আপনার জিহ্বা পরিষ্কার রাখা গুরুত্বপূর্ণ । তাই দাঁত ব্রাশ করার পর আপনার জিহ্বা ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করুন।
ব্রাশের আগে ফ্লস করুন
ব্রাশ দাঁতের উপরের এবং ভিতরের পৃষ্ঠ পরিষ্কার করলেও পাশাপাশি দাতের মাঝখানে জমে থাকা খাবার সঠিকভাবে পরিষ্কার করতে পারে না। তাই ব্রাশ করার আগে ফ্লস দিয়ে দাঁতের মধ্যবর্তী স্থানগুলো পরিষ্কার করে নিবেন।
শুধুমাত্র ব্র্যান্ডেড টুথপেস্ট ব্যবহার করুন
শুধুমাত্র পরিচিত ব্র্যান্ডের টুথপেস্ট ব্যবহার করবেন। সন্দেহ থাকলে আপনার নিকটবর্তী কোন ডেন্টিস্টের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে টুথপেস্ট ক্রয় করবেন। বাংলাদেশের প্রচলিত কিছু ভাল ব্র্যান্ডের টুথপেস্টের মধ্যে আছে – মেডিপ্লাস, পেপসোডেন্ট, সেন্সোডাইন।
অবশ্যই দানাদার এবং বিভিন্ন রঙিন বর্ণের টুথপেস্ট পরিহার করবেন। ছাই ব্যবহার থেকে বিরত থাকবেন।
পেছনের দাঁতের পেছনের পৃষ্ঠ পরিষ্কার করুন
আপনার চারটি আক্কেল দাঁত অথবা প্রতিটি মাড়ির দুই পাশে সবথেকে পেছনে যে দাঁতগুলো রয়েছে সেগুলোর পেছনের পৃষ্ঠ ভালোভাবে ব্রাশ করবেন। এই পেছনের দাঁতগুলোর পেছনের পৃষ্ঠগুলো সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হয়। তাই এসব জায়গায় দাঁতের ইনফেকশন বেশি হতে দেখা যায়।।
অনেকের টুথপেস্ট সহ এসব পৃষ্ঠ পরিস্কার করতে গেলে বমি আসে। সেক্ষেত্রে টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করার পূর্বে খালি ব্রাশ পানিতে ভিজিয়ে এই পিছনের পৃষ্ঠগুলো আগে পরিষ্কার করে নিবেন।
ছোট এবং নরম টুথব্রাশ ব্যবহার করুন
সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ করার জন্য সঠিক টুথব্রাশ প্রয়োজন। সবসময় নরম টুথব্রাশ ব্যবহার করবেন। এবং লক্ষ্য রাখবেন টুথব্রাশের মাথা যাতে ছোট হয়।
আমাদের চেম্বারে আমরা সাধারণত মেডিপ্লাস টুথব্রাশ ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। কিন্তু একই বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন যে কোন টুথব্রাশ ব্যবহার করলেই হবে।
দাঁত ব্রাশের এত নিয়ম পালন না করলে কি হবে?
অনেকে হয়তো এই লেখাটি পড়ে অবাক হচ্ছেন যে দাঁত ব্রাশের পিছনেও এত নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এসব নিয়ম পালন না করলে কি হবে? চলুন জেনে নেই।
দাঁতের ইনফেকশন ( ক্যারিজ)
সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ না করলে দাঁতের আশে আশে পাশে বিভিন্ন জায়গায় খাবার আটকে থাকে। এই খাবার ব্যবহার করে পরে জীবাণুর সংক্রামন শুরু হয় এবং দাঁতের ইনফেকশন ধরা পড়ে। এই ইনফেকশনকে আমরা ক্যারিজ বলি।
এক্ষেত্রে দাঁতে কিছু কালো কালো ক্ষতস্থানের সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীতে বাড়তে বাড়তে বড় একটি গর্ত সৃষ্টি করে। এ সময় দাঁতে প্রচন্ড ব্যথা হতে পারে। এবং এসব ইনফেকশন থেকেই পরবর্তীতে অ্যাবসেস, সিস্ট, এমনকি ক্যান্সার হতে পারে।
মাড়ির ইনফেকশন
দাঁতের পাশাপাশি পূর্বে উল্লেখিত জীবাণুগুলো মাড়িতেও ইনফেকশন সৃষ্টি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে দেখা যায় মাড়ি ফুলে যায়, মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে, দাঁতের গোড়া থেকে মাড়ি সরে আসে, মাড়ি লাল হয়ে যায়।
দাঁতের ক্ষয়
ভুল নিয়মে এবং বেশি জোর দিয়ে দাঁত ব্রাশ করলে দাঁতের উপরের পৃষ্ঠ ক্ষয় হয়ে যেতে পারে। এই ক্ষতস্থানে পরবর্তীতে ঠান্ডা গরম পানি, এমনকি বাতাস লাগলেও শিরশির করে ওঠে। এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যথাও হতে পারে।
সুতরাং
সঠিক নিয়ম মেনে ব্রাশ না করলে দাঁতের এবং মাড়ির বিভিন্ন ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পরবর্তীতে হাজার হাজার টাকার চিকিৎসা করতে হয়। তাই প্রতিদিন শুধু ব্রাশ করলেই চলবে না। দাঁত ব্রাশ করার সঠিক নিয়ম আমাদের ঠিকমতো শিখতে হবে এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই আমাদের দাঁত সম্পূর্ণরূপে সুস্থ এবং সুরক্ষিত থাকবে।
দাঁত ব্রাশ করার সঠিক নিয়মের পাশাপাশি মুখ ও দাঁতের পরিচর্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চলে আসুন আমাদের ডেন্টাল ক্লিনিকে। আমাদের অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ আপনাকে সঠিকভাবে পরামর্শ দিতে পারবেন। আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য ধন্যবাদ।