আমরা যেই সমস্যাটি নিয়ে রোগীদের সবচেয়ে বেশি আমাদের ডেন্টাল ক্লিনিকে আসতে দেখি, তা হলো মাড়ির প্রদাহ অথবা মাড়ি ফুলে যাওয়া। । সত্য কথা বলতে কি, সবার জীবনেই, কোনো না কোনো সময়ে এই মাড়ি ফোলার সমস্যা হয়ে থাকে। কিন্তু কেন মাড়ি ফুলে যায়? কিভাবে দাঁতের মাড়ি ফোলা প্রতিরোধ করা যায়? আর একবার যদি মাড়ি ফুলেই যায়, তখন কিভাবে মাড়ি ফোলার চিকিৎসা করা যায়? চলুন জেনে নেই!
মাড়ি ফোলার সবচেয়ে প্রধান কারণ হলো – দাঁতের পাথর এবং মাড়ির নিচে জমে থাকা ময়লা। এবং এই সমস্যার প্রধান ট্রিটমেন্ট হল দাঁতের স্কেলিং । যাকে অনেকেই দাঁতের ওয়াশ বলে থাকেন ।
এই আর্টিকেলে আমরা মাড়ি ফোলার কারণ এবং তার চিকিৎসা নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করব।তাই আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য অনুরোধ রইল।

কিভাবে দাঁতের মাড়ি ফুলে যায়?
এক রাতেই দাঁতের মাড়ি ফুলে যায় না । কয়েকটি ধাপের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর মাড়ির এই ফোলন হয় । চলুন এই ধাপগুলো নিয়ে বিস্তারিত জানি-
ধাপ ১ – মাড়িতে খাবার জমা
আমাদের মাড়ির দুইটি অংশ আছে । একটাকে বলা হয় “ফ্রী জিনজিভা” । মাড়ির এই অংশটিকে ফ্রি বলার কারণ হলো এটা মাড়ির সাথে লেগে থাকে না । তাই এখানে একটি ছোট্ট পকেটের মতো থাকে যেখানে খাবার এবং বিভিন্ন ধরনের ময়লা গিয়ে জমে।
ধাপ ২ – দাঁতের প্লাক এবং পাথর তৈরি হওয়া
আমরা যতই ভালোভাবে ব্রাশ করি না কেন এই ছোট পকেটের ভিতরে জমে থাকা খাবারের অংশবিশেষ কখনোই পরিষ্কার হয় না । মুখের ভিতরে থাকা বিভিন্ন জীবাণু এই খাবার খেয়ে এক ধরনের বর্জ্য পদার্থ তৈরি করে । এই বর্জ্যকে বলা হয় “প্লাক” ।
এই প্লাক পরবর্তীতে শক্ত হয়ে দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা পাথর তৈরি করে । যাতে আরো বেশি জীবাণু দাঁতের সাথে আটকে আরও বেশি প্লাক তৈরি করতে পারে ।
ধাপ ৩ – মাড়ির ইনফেকশন এবং প্রদাহ
প্লাক এর পাশাপাশি এসব জীবাণু একটি বিশেষ ধরনের এসিড জাতীয় পদার্থ তৈরি করে । এই এসিড, দাঁতের পাথর, এবং প্লাক – মিলে মাড়ির ইনফেকশন সৃষ্টি করে । এবং এর থেকেই মাড়ি ফুলে যায়। মাড়ির এই ফুলে যাওয়াকে আমরা ডেন্টালের ভাষায় বলি “ জিঞ্জিভাইটিস” ।
ঠিক এই সময় মাড়িতে শিরশির এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যথা অনুভব হতে পারে । বিশেষ করে ঠান্ডা অথবা গরম পানি খেলে শিরশির অনুভূতি হয় । অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় দাঁত ব্রাশ করার সময় মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে । অথবা মাড়ি থেকে নিজে নিজেই রক্ত পড়তে পারে।
দাঁতের মাড়ি ফোলার চিকিৎসা
দাঁতের মাড়ি ফোলার প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে স্কেলিং । যাকে অনেকেই দাঁতের ওয়াশ বলে থাকে । স্কেলিং এরপর ডাক্তারের পরামর্শ সঠিকভাবে পালন করলে দুই সপ্তাহ থেকে এক মাসের মধ্যেই শিরশির ভাব চলে যায় । এবং তিন মাসের মধ্যেই আপনার মাড়ি আবার সুস্থ হয়ে আশে ।
স্কেলিংয়ের মাধ্যমে আমরা আপনার দাঁতের উপর জমে থাকা ময়লা এবং পাথর পরিষ্কার করা হয়। এরপর মাড়ির ইনফেকশনের তীব্রতার ভিত্তিতে রোগীকে এন্টিবায়োটিক এবং মাউথ ওয়াশ দেওয়া হতে পারে। এর পাশাপাশি রোগীকে তার দাঁত এবং মাড়ি পরিষ্কার রাখার কিছু নিয়মাবলী শিখানো হয় ।
ডাক্তারের পরামর্শ সঠিকভাবে পালন করলে কয়েকদিনের মধ্যেই আপনার মাড়ির শিরশির ভাব চলে যাবে । আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আপনার মাড়ি আবার সুস্থ হয়ে পূর্বের অবস্থায় চলে আসবে ।
মাড়ি ফোলার তীব্রতা বেশি হলে চিকিৎসা
মাড়ির প্রদাহ কিছুটা তীব্র হলে অনেক সময় মাড়ি দাঁতের গোড়া থেকে সরে চলে আসে । সেক্ষেত্রে স্কেলিংয়ের পাশাপাশি রুট প্ল্যানিং করার প্রয়োজন হতে পারে।
রুট প্ল্যানিং হলো দাঁতের গোড়ায় লেগে থাকা পাথর এবং জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করা। যাতে মাড়ি আবার দাঁতের গোড়ার সাথে লেগে যেতে পারে ।
অতিরিক্ত অবহেলায় দাঁত তোলার প্রয়োজন হতে পারে !
অনেকেই সময় মত মাড়ির চিকিৎসা করেন না । অথবা চিকিৎসা করতে আসলেও ডাক্তারের পরামর্শ সঠিকভাবে পালন করেন না । সেক্ষেত্রে মাড়ির প্রদাহ আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। এবং একপর্যায়ে দেখা যায় দাঁত মুখের ভিতরেই হালকা চাপে নড়াচড়া করছে। এসব ক্ষেত্রে দাঁত তুলে ফেলা লাগতে পারে ।
তাই অবশ্যই মাড়ির শিরশির অথবা মাড়ি থেকে রক্ত পড়া লক্ষণ করলে শীঘ্রই চিকিৎসা নেওয়া উচিত । এবং চিকিৎসার পর ডাক্তারের পরামর্শ সঠিকভাবে পালন করা উচিত ।
দাঁতের মাড়ি ফোলা প্রতিরোধের উপায়
ছোটকালে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় আমরা অনেকেই হয়তো রচনা লিখেছি “ প্রতিরোধ চিকিৎসা হইতে শ্রেয়”। এটা শুধু কোন প্রবাদ না । কথাটি আসলেই সত্য ।
আমাদের অভ্যাসে খুবই ক্ষুদ্র কিছু পরিবর্তন আনলেই আমরা সহজে মাড়ি ফোলা প্রতিরোধ করতে পারি । তাই চলুন শিখে নেই কিভাবে আমরা দাঁতের মাড়ি ফোলা প্রতিরোধ করতে পারি ।
দুই বেলা ব্রাশ করা
প্রতিদিন সকালের নাস্তা এবং রাতের খাবারের পর সঠিক নিয়মে দাঁত ব্রাশ করতে হবে । এভাবে দুই বেলা ব্রাশ করলে ব্যাকটেরিয়া আপনার মুখে পর্যাপ্ত প্লাক এবং পাথর তৈরি করতে পারে না । এবং আপনার মাড়ি সুস্থ থাকে ।
সঠিক নিয়মে দাঁত ব্রাশ করা
শুধু দাঁত ব্রাশ করলেই হবে না । তা সঠিক নিয়মে করতে হবে । আর আমাদের দেশের ৯৯% মানুষই ভুল ভাবে দাঁত ব্রাশ করেন। দাঁত ব্রাশের সঠিক নিয়মের যে পদ্ধতি তাকে বলা হয় “বাস মেথড” ।
সংক্ষেপে বললে, এই নিয়ম অনুসারে আপনার ব্রাস ধরতে হবে দাঁতের সাথে ৪৫ ডিগ্রি বাঁকিয়ে । পাশাপাশি দাঁতের মাঝখানে সামান্য চাপ দিয়ে আপনার ব্রাশের মাথা ঢোকাতে হবে ।
তারপর আলতোভাবে সামনে-পিছনে করে ব্রাশ করতে হবে। এছাড়াও উপরের দাঁতের ক্ষেত্রে নিচের দিকে ঘোরাতে হবে এবং নিচের দাঁতের ক্ষেত্রে উপরের দিকে ঘোরাতে হবে । শুধু দাঁতের বাইরের পৃষ্ঠ পরিষ্কার করলে হবে না ভেতরের পৃষ্ঠও পরিষ্কার করতে হবে ঠিক একই নিয়মে । দাঁতের পিছনের পৃষ্ঠ পরিষ্কার করার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
ছাই দিয়ে দাঁত ব্রাশ করা, এবং অপরিচিত ব্র্যান্ডের টুথপেস্ট ব্যবহার করা পরিহার করতে হবে ।
ফ্লস ব্যবহার করা
ব্রাশ করে দাঁতের উপরের পৃষ্ঠ পরিষ্কার করা গেলেও, মাঝখানে আটকে থাকা খাবার এবং অন্যান্য ময়লা পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না । ওগুলো পরিষ্কার করার জন্য প্রয়োজন ডেন্টাল ফ্লস । হয়তো অনেকে ভাবছেন যে কাপড় সেলাইয়ের সুতা অথবা কাঠি (দাঁত খিলান) ব্যবহার করেইতো পরিষ্কার করা যায়। কিন্তু না । এগুলো ব্যবহার করলে মাড়িতে ক্ষতের সৃষ্টি হয় । যা থেকে ইনফেকশন হতে পারে ।

ফ্লস হলো দাঁতের মাঝখানে জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করার জন্য তৈরি বিশেষ এক ধরনের মেডিক্যাল সুতা । যা ব্যবহার করে আপনি সহজেই দাঁতের মাঝখান পরিষ্কার রাখতে পারবেন, আপনার মাড়িকে আঘাত না করে।
বছরে দুইবার স্কেলিং (দাঁত ওয়াশ) করা
আমরা আগেই বলেছি যে শুধু দাঁত ব্রাশ করলেই দাঁতের আশেপাশে জমে থাকা সকল ময়লা পরিষ্কার হয় না । তাই মাড়ি সুস্থ রাখার জন্য বছরে অন্তত দুইবার দাঁতের স্কেলিং করে নেওয়া উচিত ।
ধূমপান, পান-সুপারি, গুল এবং অন্যান্য নেশা জাতিয় দ্রব্য থেকে বিরত থাকা
এসব নেশা জাতীয় দ্রব্য আমাদের দেশে খুবই প্রচলিত। এবং এগুলোর প্রত্যেকটাই মাড়ি ফোলার কারণ হতে পারে। সরাসরি মাড়ি ফোলার কারণ না হলেও এগুলো আপনার মাড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় ।
শর্করা জাতীয় খাদ্য কম খাওয়া
ভাত, রুটি, পাউরুটি, বিস্কুট – এগুলো আমাদের সবার খুবই প্রিয় খাদ্য । কিন্তু এসব শর্করা জাতীয় খাবার দাঁতের সাথে লেগে থাকে । এছারাও, এসব খাবার ব্যাকটেরিয়া খুবই পছন্দ করে ।
তাই সম্ভব হলে আপনি যদি এসব শর্করা জাতীয় খাদ্য কমিয়ে আমিষ জাতীয় খাদ্য এবং পানি বেশি করে খান তাহলে মাড়ির ইনফেকশনের প্রবণতা কমে যাবে । প্রতিবার পানি খাওয়ার সময় একটু কুলি করে খাওয়া দাঁতের জন্য উত্তম ।
প্রতিরাতে লবণ পানি দিয়ে কুলকুচি করা
দাঁতের অধিকাংশ রোগ প্রতিরোধের একটি মহৌষধ হল লবণ পানি । তাই আপনি যদি প্রতিদিন সকালে এবং রাতে, ব্রাশ এবং ফ্লস করার পর, কুসুম গরম লবণ-পানি দিয়ে কুলি করার অভ্যাস করে নিতে পারেন, তাহলে আপনার মাড়ি সুরক্ষিত থাকবে ।
সুতরাং
সাধারণ কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করলে সহজেই দাঁতের মাড়ি ফোলা প্রতিরোধ করা যায় । আর মাড়ি যদি একবার ফুলে যায় তাহলে শীঘ্রই চলে আসুন লুমিকা ডেন্টালে ।
আমাদের অভিজ্ঞ দন্ত চিকিৎসকগণ আপনার মাড়ি ফোলার সঠিক চিকিৎসা প্রদান করবেন । সিরিয়াল নেওয়ার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।